দীর্ঘদিন ধরেই দেশের ৬৮টি কারাগারের প্রায় সবগুলোতে টাকার বিনিময়ে বন্দিদের সুযোগ-সুবিধা দেওয়াসহ নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি হচ্ছে। এর মধ্যে মাদক কারবার অন্যতম। কারারক্ষী থেকে শুরু থেকে শীর্ষ কারা কর্মকর্তারাও এমন অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন। এসব দুর্নীতি-অনিয়ম দূর করতে কারাগারগুলোতে গণবদলির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
চলতি মাসেই কারাগারে বড় ধরনের রদবদল হওয়ার কথা রয়েছে।
সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এক বৈঠকে কারাগারে অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে ক্ষোভ জানানো হয়। যারা দীর্ঘদিন ধরে একই কর্মস্থলে চাকরি করছেন তাদের বদলি করার জন্য মৌখিক নির্দেশনা দেয় মন্ত্রণালয়। এরপর কারা অধিদপ্তর একটি কমিটি করে। ওই কমিটির সুপারিশে গণহারে বদলি করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে বলে একটি সূত্র জানিয়েছে।
জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান সম্পতি বলেছিলেন, দেশ থেকে দুর্নীতি ও নানা অনিয়ম দূর করতে সরকার নানাভাবে চেষ্টা চালাচ্ছে। কারাগারসহ সব স্থানে অনিয়ম ঠেকাতে প্রশাসন কাজ করছে। কারাগারে যারাই অনিয়ম ও দুর্নীতি করছে তাদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনা হচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, বছরের পর বছর ধরেই কারাগারে নানা অনিয়ম চলে আসছে।
এই নিয়ে তারা বেশ ক্ষুব্ধ। কারাগার হচ্ছে সংশোধনাগার। কিন্তু বন্দিদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে তাদের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। কারাগারের ভেতর মাদক কারবারও চলছে। বেশিরভাগ কর্মকর্তা ও কারারক্ষী একই কর্মস্থলে বছরের পর বছর ধরে চাকরি করছেন। এ অবস্থা থেকে বের হতে কারা অধিদপ্তরকে বলা হয়েছে।
কারা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক কর্নেল মো. আবরার হোসেন দেশ রূপান্তকে বলেন, “কমিটির সদস্যরা ইতিমধ্যেই তাদের কাজ সম্পন্ন করেছে। আশা করছি কারাগারের ‘গার্ডিং স্টাফ’ বদলি প্রথা সারা দেশে উন্মুক্ত করা গেলে ভালো কিছু হবে। ”
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, দীর্ঘদিন ধরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারসহ দেশের সবকটি কারাগারেই নানা অব্যবস্থাপনা চলে আসছে। বিশেষ করে মাদক কারবার। এর সঙ্গে বন্দিদের পাশাপাশি কারারক্ষীরা পর্যন্ত জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। বন্দিদের জন্য কেনা খাবারের উপকরণ হরিলুটের ঘটনাও আছে। বছর খানেক আগে কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারের কারারক্ষী রোমান ভূঁইয়া বন্দিদের মাদক ও সেলফোন সরবরাহের সময় ধরা পড়েন। এর আগে লালমনিরহাটে মাদক পাচারের অভিযোগে একযোগে তাৎক্ষণিক বদলি করা হয় ১৪ কারারক্ষীকে। দুর্নীতির অভিযোগে সাত বছর কারাদ- হয়েছে শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা পার্থ গোপাল বণিকের। এ ছাড়া প্রায়ই কারা অভ্যন্তরে মাদক পাচারের অভিযোগে আটক হন কারারক্ষীরা। কিন্তু ঘটনার পেছনের রাঘব-বোয়ালরা থেকে যাচ্ছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় বাসিন্দা ও কারা কর্মকর্তাদের যোগসাজশে কারাগারে অপরাধে জড়াচ্ছেন কারারক্ষীরা।
কারা সূত্র জানায়, অনেক কারারক্ষীর বাড়ি এবং কর্মস্থল একই বিভাগে হওয়ায় স্থানীয়দের সঙ্গে মিশে নানা অনিয়মে জড়িয়ে পড়ার তথ্য উঠে এসেছে কারা অধিদপ্তরের পর্যবেক্ষণে। এতে একদিকে যেমন কারারক্ষীদের অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে, অন্যদিকে কারাগারগুলোতে তৈরি হচ্ছে নিরাপত্তা ঝুঁকিও। এমন পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পেতে বদলি প্রথায় পরিবর্তনের পরিকল্পনা নিয়েছে অধিদপ্তর। সম্প্রতি বদলি প্রথা পরিবর্তন করার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির সদস্যরা হচ্ছেন- সভাপতি অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক, সদর দপ্তরের ঢাকা বিভাগের কারা উপমহাপরিদর্শক, খুলনা বিভাগের কারা উপমহাপরিদর্শক, পাবনা জেলা কারাগারের জেল সুপার ও কারা অধিদপ্তরের সহকারী কারা মহাপরিদর্শক (প্রশাসন)। ওই কমিটিকে মতামত ও নির্দেশনা জমা দিতে বলা হয়েছে। ইতিমধ্যে কমিটি কাজ শেষ করেছে। ওই নির্দেশনা হাতে পাওয়ার পরই বদলির উদ্যেগ নেওয়া হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, কারারক্ষী ও মহিলা কারারক্ষী থেকে প্রধান কারারক্ষী পর্যন্ত পদগুলোতে দায়িত্বরতদের বলা হয় গার্ডিং স্টাফ। তারা মূলত কারা অভ্যন্তরের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বগুলো পালন করে থাকেন। এজন্য বন্দিদের খুব কাছাকাছি থেকে কাজ করার সুযোগও তৈরি হয় তাদের। আর এই সুযোগে বন্দিদের মাদক, ফোন সরবরাহসহ নানা অনিয়ম-দুর্নীতি হয়। নানা ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণের পরেও এমন অনিয়ম থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি দেশের ৬৮টি কারাগার।
কয়েকজন কারা কর্মকর্তা বলেন, নিজ বিভাগে কারারক্ষীদের পদায়ন করা হচ্ছে। বদলি করা হলেও তা ওই বিভাগের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে। এতে করে দীর্ঘদিন তারা নিজ বিভাগেই কর্মরত থাকছেন। আবার কারাগারগুলোতেও একই বিভাগের অপরাধীরা থাকেন। এতে করে তাদের মধ্যে দ্রুততম সময়ের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। সেখান থেকে পরবর্তী সময়ে নানা ধরনের অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন কারারক্ষীরা। আবার কিছু কিছু কারারক্ষী স্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সঙ্গে আঁতাত করে কারা অভ্যন্তরে ক্যান্টিন বাণিজ্যেও জড়িয়ে পড়েন।
সূত্র জানায়, প্রায় দুই বছর আগে মাদক পাচারের অভিযোগে লালমনিরহাট কারাগারের ১৪ কারারক্ষীকে তাৎক্ষণিক বদলি করা হয়। এ ঘটনার পর কারা অধিদপ্তরের গোয়েন্দারাও মাঠে নামেন। তারা দীর্ঘদিন ধরে কারা সংশ্লিষ্ট অপরাধ নিয়ে গোপনে তদন্ত শুরু করেন। তদন্তে জানা যায়, দীর্ঘদিন ঘুরেফিরে একই বিভাগে চাকরি করার সুবাদে স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠে। আর এ কারণে কারারক্ষীরা অপরাধে জড়াচ্ছেন। এরপর কারারক্ষীদের বিভিন্ন বিভাগে বদলি করার উদ্যোগ নেওয়া হয়।