গাইবান্ধা প্রতিনিধি : গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলায় ভুয়া সোলার কোম্পানিতে চাকরি দেওয়ার কথা বলে প্রায় ২৫০ জনের কাছ থেকে ৩ থেকে ৪ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। ওই সোলার কোম্পানির নাম এটিএক্স সোলার এনার্জি লিমিটেড। এ নিয়ে গত ২৬ জানুয়ারি গোবিন্দগঞ্জ থানায় লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন উপজেলার হরিরামপুর ইউনিয়নের হরিরামপুর গ্রাামের আখতারুল ইসলাম নামের এক ভুক্তভোগী। চাকরির আশায় সুদের উপর ও ধার-দেনা করে নেওয়া টাকার জন্য এখন চাপ দিচ্ছেন পাওনাদাররা। এনিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন তারা। এদিকে, অভিযোগ দায়েরের ৪ সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও পুলিশ এ বিষয়টি নিয়ে এগুতে পারেনি।
অভিযোগে আখতারুল ইসলাম উল্লেখ করেন, ঢাকার কাকরাইল এলাকার ইস্টার্ন কমার্শিয়াল কমপ্লেক্সের নবমতলায় এটিএক্স সোলার এনার্জি লিমিটেডের কার্যালয় রয়েছে। ২০২০ সালের নভেম্বর মাসের দিকে এই সোলার কোম্পানির নামে উপজেলার হরিরামপুর ইউনিয়নের বার্নিতলা এলাকায় শাখা কার্যালয় স্থাপন করা হয়। এই শাখা কার্যালয়ের মাধ্যমে একটি সোলার প্লান্ট চালু করা হবে এবং এরজন্য জনবল প্রয়োজনের বিষয়টি স্থানীয়দের মৌখিকভাবে জানানো হয়।
গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার রাখালবুরুজ ইউনিয়নের রাখালবুরুজ খামারপাড়া গ্রামের আবদুল বাকী সরকারের ছেলে আজাহার আলী সরকার (৬১) জমিদাতা, আজাহার আলী সরকারের ছেলে খালেকুজ্জামান মাসুদ (৩৮) এটিএক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি), জাহিদ হাসান ওরফে সোহেল (৩৩) সদস্য, রিয়াদ হাসান (৩০) সদস্য, জাহাঙ্গীর আলম ওরফে বাদশা (৪২) জিএম, একই ইউনিয়নের সরকারপাড়া গ্রামের ওছমান সরকারের ছেলে শামীম সরকার (৪৫) এজিএম, আমিরুল ইসলামের ছেলে শিহাব সরকার (৩৩) অফিস সহায়ক এবং মিয়াপাড়া গ্রামের মোফাজ্জল হোসেনের ছেলে সাদা মিয়া (৪৭) অফিস সহায়ক হিসেবে কর্মরত ছিলেন এই কোম্পানির। এরা প্রত্যেকে প্রত্যেকের নিকটআত্মীয় (আপন ভাই, চাচা ও মামা হন)।
অভিযোগে আরও উল্লেখ করা হয়, অনেক বেকার যুবকদের মোটা অংকের বেতনভাতা দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে চাকরি দেয়ার নামে বিভিন্ন সময়ে কোটি-কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। জুনিয়র অ্যাক্সিকিউটিভ অ্যাডমিন পদে আমাকে নিয়োগ দিয়ে পাঁচ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন তারা। ২০২০ সালের ৬ ডিসেম্বর আমি যোগদানের পর তাদের বিভিন্ন কর্মকান্ড দেখে সন্দেহ হলে বিভিন্ন জায়গায় খোঁজখবর নিয়ে বুঝতে পারি যে, এটি একটি ভুয়া কার্যালয়।
এ সময় তাদের কাছে টাকা চাইলে তারা ফেরত দেয়ার কথা বলে কালক্ষেপণ করে। ততক্ষণে তাদের প্রতারণার কথা এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে ২০২১ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারির দিকে কার্যালয় গুটিয়ে নিয়ে এক রাতে তারা পালিয়ে যায়। পরে তাদের মোবাইল ফোনে কল করলে মোবাইল বন্ধ পাওয়া যায়। চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি গোবিন্দগঞ্জ পৌরসভার বুজরুক বোয়ালিয়া শিল্পপাড়া এলাকায় আজাহার আলী সরকারের বাড়িতে গেলে তিনি টাকা না দিয়ে ভয়ভীতি ও হুমকি দিয়ে তাড়িয়ে দেন।
পরে স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের শরণাপন্ন হলে আজাহার আলী সরকার কয়েকবার টাকা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েও দেননি। উপরন্তু তিনি আমার দুলাভাই এনামুল হকের নামে মিথ্যা ও বানোয়াট অভিযোগ তুলে গত ১১ জানুয়ারি গোবিন্দগঞ্জ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরী (জিডি) করেন। উল্লিখিত ঘটনা সরেজমিনে তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানানো হয় ওই অভিযোগে।
ভূয়া এই কোম্পানির প্রতারনার বিষয়টি ছড়িয়ে পড়লে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে বিষয়টি নিয়ে তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কাছে সাংবাদিকরা জানতে চাইলে তিনি জানান, স্থানীয় সাংসদের একটি ডিও লেটার ছাড়া আর কিছুই দেখাতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি। সেসময় তৎকালীন জেলা প্রশাসকও জানিয়েছিলেন প্রতিষ্ঠানটি অবৈধ। তবে, সেই ডিও লেটারে প্রাথমিক কাজ শুরু করার জন্য লেখা আছে বলে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে।
কয়েকজন ভুক্তভোগী বলেন, একেকজনের কাছ থেকে দেড় লাখ টাকা থেকে শুরু করে ও শেয়ার দেয়ার কথা বলে কোচাশহর ইউনিয়নের এক কলেজের কর্মচারীর কাছে ১৪ লাখ, রাখালবুরুজের একটি উচ্চ বিদ্যালয়ের এক শিক্ষকের কাছে ১৮ লাখ, হরিরামপুরের একটি উচ্চ বিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষকের কাছে সর্বোচ্চ ২৮ লাখ টাকা পর্যন্ত নিয়েছে তারা। তাদের কেউ সুদের উপর টাকা নিয়েছে, ধার-দেনা করেছে, গরু, ছাগল বিক্রি করেছে, জমি বিক্রি করেছে, বন্ধক নেওয়া জমি ছাড়িয়েছে ও সঞ্চয় করা টাকা দিয়েছে চাকরির জন্য। অনেকে এই চাকরির আশায় চাকরি ছেড়ে দিয়ে এসে এখন বিপাকে পড়েছেন। গাইবান্ধা, রংপুর, বগুড়া ও সিরাজগঞ্জসহ আরো বেশ কয়েকটি জেলার চাকরি প্রত্যাশী সবাই এখন পথে বসেছেন।
আখতারুল ইসলাম বলেন, ১৮০ জনের মতো একসাথেই চাকরি করেছি। এছাড়া যোগদানের অপেক্ষায় ছিল আরও অনেকে। সে হিসেবে প্রায় ২৫০ জনের কাছ থেকে ৩ থেকে ৪ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে চক্রটি। এমডি খালেকুজ্জামান মাসুদ ঢাকায় পলাতক রয়েছেন। এছাড়া সবাই নিজ গ্রামে ও গোবিন্দগঞ্জ শহরে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ালেও পুলিশ তাদের ধরছে না। টাকা উদ্ধার করে দিতে পারছে না। আখতারুল ইসলাম আরও বলেন, আমরা তাদের ধরলে এমডি ফোন করে একের পর এক তারিখ দেয় কিন্তু কোন টাকা দেয় না।
গোবিন্দগঞ্জ থানার এসআই আলাউদ্দিন আজাহার আলী সরকারকে একবার থানায় ডেকেও পাঠান। গত ১১ ফেব্রুয়ারি থানায় বসে আলোচনার পরও কোন সমাধান মেলেনি।
আখতারুল ইসলামের দুলাভাই এনামুল হক বলেন, থানায় বসে আলোচনার সময় একজনকে টাকা দিলে সবাইকেই দিতে হবে, আমি এখন কয়জনকে টাকা দেব বলে মন্তব্য করেন আজাহার আলী সরকার। শ্যালকের টাকা উদ্ধারের জন্য চেষ্টা করায় আমার নামে মিথ্যা অভিযোগে জিডিও করেন তিনি। এখন গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা শহরে এটিএক্সের কার্যালয়টিও বন্ধ। সেখানে কেউ আর বসেন না। ভূয়া কোম্পানির এমডি খালেকুজ্জামান মাসুদের মুঠোফোনে কয়েকবার কল করলে তার নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়।
তবে, তার বাবা প্রকল্পের জমিদাতা আজাহার আলী সরকার বলেন, এমডি খালেকুজ্জামানের বিরুদ্ধে যা ব্যবস্থা নেওয়া ওরা নিক। একথা আমি তাদেরকে জানিয়েছি। তার বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারবো না। কেননা তার সাথে আমার দীর্ঘদিন থেকে যোগাযোগ নেই। এসব লেনদেনের সাথে আমি ছিলামও না। লেনদেন হয়েছে কিনা সেটাও আমি জানি না।
এসব বিষয়ে গোবিন্দগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ ইজার উদ্দিন বলেন, এ ধরনের কোন অভিযোগ পাইনি। এমন ঘটনার কথা ঠিক মনে পড়ছে না। বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখবো।
গোবিন্দগঞ্জে সোলার কোম্পানিতে চাকরির নামে কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ
Read Time:9 Minute, 41 Second