টর্নেডো, টাইফুন, কালবৈশাখী, তুফান—এমন নাম ব্যবহার করে অনলাইনে পণ্য বিক্রির আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন প্রচার করত হালের ই–কমার্স প্রতিষ্ঠান দালাল প্লাস। বিজ্ঞাপনে বলা হতো মুঠোফোন, গাড়ি ও মোটরসাইকেলসহ বিভিন্ন পণ্যের মূল্যের ওপর ৪৫ শতাংশ ছাড় ও ৩০ দিনের মধ্যে সরবরাহের কথা। এভাবে ৭ মাসে প্রায় ২০০ কোটি টাকা সংগ্রহ করে প্রতিষ্ঠানটি। এর মধ্যে গ্রাহকের ৭৫ কোটি ৭২ লাখ ৯৪ হাজার টাকার পণ্য এখনো বুঝিয়ে দেয়নি তারা।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) বলছে, ব্যক্তিগত ভোগবিলাসে, আত্মীয়–স্বজনের ব্যক্তিগত ব্যাংক হিসাবে ও বিভিন্ন নামে প্রতিষ্ঠান খুলে গ্রাহকের পণ্যের টাকা সরিয়েছেন দালাল প্লাসের পরিচালকসহ তিনজন। তিন মাসের অনুসন্ধানে দালাল প্লাসের বিরুদ্ধে ৭৫ কোটি ৭২ লাখ ৯৪ হাজার টাকার পণ্য বুঝিয়ে না দেওয়ার তথ্য উঠে এসেছে। এর মধ্যে ৪১ কোটি ৭ লাখ ৩৫ হাজার টাকা আত্মসাতের প্রমাণ পাওয়া গেছে। বাকি টাকা কী হয়েছে তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
শনিবার রাজধানীর ধানমন্ডি থানায় অর্থ পাচার আইনে দালাল প্লাসের চেয়ারম্যান সালেহ উদ্দিন মুরাদ, ব্যবস্থাপনা পরিচালক আজিজুল হক ও পরিচালক আবু জুবায়ের হোসেন রাব্বির বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগের পরিদর্শক ইব্রাহিম হোসেন বাদী হয়ে মামলাটি করেন। তিনজনই বর্তমানে আত্মগোপনে রয়েছেন।
সিআইডি বলছে, লোভনীয় ছাড় দেওয়ার নামে ৪৫ হাজারের বেশি ফরমায়েশ (অর্ডার) নিয়েছিল দালাল প্লাস। সব ফরমায়েশের টাকা অবশ্য গ্রাহকেরা পরিশোধ করেননি।
মোট ৮ হাজার ২২২টি ফরমায়েশ (একটি ফরমায়েশে একাধিক পণ্য থাকতে পারে) বাবদ ১২৬ কোটি ৮৩ লাখ ৩১ হাজার টাকা সংগ্রহ করার প্রমাণ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ৩ হাজার ৬০৪টি ফরমায়েশের বিপরীতে গ্রাহকের ৭৫ কোটি ৭২ লাখ টাকার পণ্য না দিয়ে আত্মগোপনে চলে যান প্রতিষ্ঠানটির শীর্ষ কর্মকর্তারা। এসব টাকা আসামি ও তাঁদের আত্মীয়দের ১৯টি ব্যাংক হিসাবে সরিয়ে নেওয়া হয়।
অর্থ পাচার আইনে করা মামলার এজহারে উল্লেখ করা হয়েছে, গ্রাহকের ৪১ কোটি ৭ লাখ ৩৫ হাজার টাকার মধ্যে ৩৫ কোটি ৫৭ লাখ টাকা বিভিন্ন সময় আসামিরা ব্যাংক থেকে তুলে আত্মসাৎ করেছেন। ৫ কোটি টাকা দালাল প্লাসের মালিকপক্ষের প্রতিষ্ঠান ‘ফ্রিডম ৭১’ ও ‘আইটি ইনস্টিটিউট’–এর একটি ব্যাংকের বরিশাল শাখার হিসাবে স্থানান্তর করা হয়। এ ছাড়া দুটি ল্যান্ড ক্রুজার গাড়ি কেনার জন্য দালাল প্লাসের পরিচালক আবু জুবায়ের উত্তরার একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে ৫০ লাখ টাকা অগ্রিম দিয়েছিলেন।
সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবির বর্তমান কাগজকে বলেন, অনুসন্ধান শেষে অর্থ পাচার আইনে তিনজনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তদন্তে টাকার অঙ্ক ও আসামির সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।
রাজধানীর ধানমন্ডির জিগাতলা এলাকার এএনজেড স্কয়ারের পঞ্চম তলায় অফিস ভাড়া নিয়ে ২০২১ সালের জানুয়ারিতে ব্যবসা শুরু করে দালাল প্লাস। গ্রাহকদের অনেকেই প্রতারিত হয়ে প্রতিষ্ঠানটির শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ধানমন্ডি ও মতিঝিল থানা এবং আদালতে একাধিক প্রতারণা মামলা করেন। অর্থ ফেরত পাবেন না—এমন আশঙ্কা থেকে অনেক গ্রাহক মামলা করেননি।
আবদুল্লাহ মামুন নামের এক গ্রাহক বর্তমান কাগজকে বলেন, আত্মীয়দের কাছ থেকে ধার নিয়ে দালাল প্লাসে মোটরসাইকেলসহ প্রায় ১৮ লাখ টাকার বিভিন্ন পণ্যের ফরমায়েশ দিয়েছিলেন তিনি। প্রায় ৫ লাখ টাকার পণ্য পেয়েছেন। বাকি টাকার পণ্য না দিয়ে হঠাৎ অফিস বন্ধ করে দেয় দালাল প্লাস। ধারের টাকা ফেরত দিতে না পেরে তিনি এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ছাড়ে পণ্য দেওয়ার নামে গ্রাহকের কাছ থেকে টাকা সংগ্রহ করতেন আসামিরা। তবে এ টাকা সরাসরি দালাল প্লাসের ব্যাংক হিসাবে না নিয়ে ‘ব্রোকার ডিজিটাল সলুশন লিমিটেড’ নামের আরেক প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তর করা হতো। গ্রাহকের টাকা দিয়ে দালাল বাজার, দালাল ট্রিবিউন, দালাল টিভি, দালাল প্রাইম ও দালাল ফুডসহ ১০টি প্রতিষ্ঠান খোলার উদ্যোগ নেন আসামিরা।