বাক ও শারীরিক প্রতিবন্ধী বাবু মিয়া। ছোটবেলা থেকেই পড়ালেখার প্রতি প্রবল আগ্রহ। চালচুলোহীন দরিদ্র মা-বাবার ঘরে জন্ম তার। তিন বছর বয়সে সড়ক দুর্ঘটনায় বাবাকে হারান।
আছে আরেকটা ছোট ভাই। দুই সন্তানের খাবার আর লালনপালনের খরচ জোগাতে তাদের মা ঢাকায় চলে আসেন গার্মেন্টসে চাকরি করতে। বাবু ও তার ছোট ভাই নানির কাছে বড় হয়। পড়ালেখার প্রতি আগ্রহ দেখে তার নানি বাবু মিয়াকে সামর্থ্য অনুযায়ী পড়াতে থাকেন। ছোট ভাই ইমন চলে যায় মায়ের কাছে। ইমন ঢাকায় কাজ করে। মা বাবুর খরচ পাঠায় তার নানির কাছে। কষ্টে চলে জীবন। আর বাবু মিয়ার পড়ালেখার প্রতি ঝোঁক আশপাশের সবাইকেই উৎসাহিত করে।
বাবু সফলতার সঙ্গে এইচএসসি পরীক্ষায় পাস করে ভর্তি হয় মাগুরা আদর্শ কলেজে। এর মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান তার নানি। বাবুর জীবনে নেমে আসে ঘোর বিপদ। মামা-মামিরা আর তাকে রাখতে চায় না। খাবার জোটে না। প্রতিবন্ধীকে কে আশ্রয় দেবে!
থেমে থাকা বাবু মিয়ার জীবন আবার গতি পায়, মুজিববর্ষ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া উপহারের বিশেষ ঘর পেয়ে। বাবু মিয়া প্রয়োজনের বেশি চান না। পড়ালেখা শেষ করে একটা চাকরি হলেই তার জীবন চলে যাবে। তার মতো এরকম বাক ও শারীরিক প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য কিছু করতে চান বাবু মিয়া।
মাগুরা সদরের হাজরাপুর ইউনিয়নের ইছাখাদা গ্রামে আশ্রয়ণ প্রকল্পের পাকা ঘরে নিজের স্বপ্নের পথে এগিয়ে যাচ্ছেন বাবু মিয়া। গত শুক্রবার ইছাখাদায় বাবু মিয়ার বাড়িতে ঢুকতেই দেখা যায়, তিনি রান্নার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ঘর পাওয়ার উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে বাবু মিয়া বলেন, ‘তিন বছর বয়সের সময় আমার বাপ মারা গেছে। তার কোনো জমি-জায়গা ছিল না। বাপে মরার পর আমার আরেকটা ভাই হইছে। তারপর নানিবাড়ি চলে গেছি। মা আমাদের ভরণপোষণের জন্য ঢাকায় গার্মেন্টসে চাকরি নিল। তারপর ছোট ভাইটা একটু বড় হওয়ার পর সেও ঢাকায় গেছে। আমি প্রতিবন্ধী মানুষ। এতিমের মতন মানুষ হইছি। ওইখানে (নানিবাড়ি) থাকতাম। দুইবেলা খেতে পারতাম না, একবেলা খেতে পারতাম না এ রকমভাবে মানুষ হইছি। লাস্টে নানিও গাড়ি এক্সিডেন্টে দুনিয়া থ্যাইকা চলে গেছে। ’
বাবু যখন কথা বলছিলেন তখন তার চোখে-মুখে আবেগ। অনেক কষ্ট করে কথা বলছিলেন। অনেক শব্দ বোঝা যায় না। অনেক সময় নিয়ে কথা বলতে হয়। তবে লিখে দিতে পারেন একবারে স্পষ্ট ভাষায়। বললেন, ‘আমি স্বাভাবিক মানুষের মতো চলাফেরা করতে পারি না। আমি স্পষ্ট করে কথা বলতে পারি না। নানি মারা যাওয়ার পর আমার জীবন অচল হয়ে গিয়েছিল। মামা-মামি রাখতে চায় না। আমার খাওয়াদাওয়া, লেখাপড়া বন্ধ হওয়ার মতো অবস্থা। মা আর ভাই ঢাকা কাজ করে। আমি কী করব?’
ঘর পাওয়ার আনন্দ বোঝাতে গিয়ে দুই হাত দুই পাশে প্রসারিত করে প্রতিবন্ধী বাবু মিয়া বলেন, ‘(আমি) বিশাল খুশি। এই বাড়ি (আমার) জীবন পাল্টে দিয়েছে। আমি এখন নিজের বাড়িতে থাকি, নিজের ঘরে বসে পড়ালেখা করি। আমি সব সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য দোয়া করি। তিনি আমাকে বাঁচিয়েছেন। আমি তাকে ধন্যবাদ দিব না। প্রধানমন্ত্রীর জন্য ধন্যবাদ ছোট হয়ে যাবে। আমি সারা জীবন তার কাছে কৃতজ্ঞ। তাকে সব সময় সম্মান করব। আমি তো আজীবন তার জন্য হাত তুলে দোয়া করব। এখনো করব, ভবিষ্যতে করব। ’
মাগুরা আদর্শ কলেজের ইসলামের ইতিহাস বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র বাবু মিয়া। এখন তার লক্ষ্য সরকারি চাকরি পাওয়া। একটা চাকরি পেলে তার জীবনটা বদলে যাবে। সেই লক্ষ্যে বাবু তার পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছেন। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা জানতে চাইলে বাবু মিয়া বলেন, ‘আমার একটা সরকারি চাকরি হলে হয়েই যায়। আর কোনো কিছু না। যেহেতু ঘর পাইছি, একটা ছোট সরকারি চাকরি পেলে জীবনডা একটু ভালো হতো। ’
বাবু মিয়া সম্পর্কে মাগুরার জেলা প্রশাসক (ডিসি) ড. আশরাফুল আলম বলেন, ‘সে শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী একটা বালক। তার একটি ছোট ভাই আছে। ঝিনাইদহে থাকা অবস্থায় তার বাবা সড়ক দুর্ঘটনার মারা যায়। তার মা দুই ছেলেকে নিয়ে মাগুরা সদর উপজেলার হাজরাপুর ইউনিয়নে তার নানার বাড়িতে চলে আসে। তারা অভাব-অনটনে থাকে। অভাব দেখতে পেয়ে তার মা ঢাকায় গার্মেন্টসে চাকরি করে। তার ছোট ভাই নারিন্দাতে একটি গ্যারেজে কাজ করে। ’
বাবু মিয়া শারীরিক প্রতিবন্ধী হলেও মেধাবী উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সে পড়াশোনায় ভালো। নানির রান্না করা খাবার খেত। নানির সঙ্গে সময় কাটাত। হঠাৎ করে তার নানি মারা যাওয়ার পর সে প্রচণ্ডভাবে ভেঙে পড়ে। সে তার অসহায়ত্বের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রীকে এসএমএস দেয়। পরে আমরা তাকে তার নানার বাড়িতে ঘর তুলে দিতে চাইলেও সে সেখানে থাকতে চায় না। পরে সে নানার বাড়ির আশপাশে থাকতে চায়। আশ্রয়ণ প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ে তাকে আমরা ঘরটা করে দেই। ’
ডিসি ড. আশরাফুল আলম বলেন, ‘জায়গা পেয়ে, ঘর পেয়ে সে সাহস পেয়েছে। সে ভাবে একটা বড় চাকরি করবে। তার আগের যে দুঃখ ছিল, এই ঘরের মাধ্যমে তার স্বপ্নের বাস্তবায়ন হয়েছে। ’ বাবু মিয়া ভালো একটা চাকরি পাবে বলেও প্রত্যাশা করেন তিনি।
বাবু মিয়াকে অত্যন্ত সৎ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘তার যা প্রয়োজন তাই নেয়। দুটো কম্বল দিলে একটা ফিরিয়ে দেয়। কারণ তার একটা প্রয়োজন। তাকে সবাই সহায়তা করে। তার মা গার্মেন্টস থেকে টাকা পাঠায়, এটা দিয়েই সে চলে। ’
ডিসি ড. আশরাফুল আলম জানান, আশ্রয়ণ প্রকল্পের অন্য ঘরের থেকে বাবু মিয়ার ঘর তৈরিতে খরচ বেশি হয়েছে। এই ঘরের দাম জমিসহ ১৫/১৬ লাখ টাকা পড়েছে। প্রতিবন্ধী হওয়ায় হাইওয়ের পাশে তাকে বাড়ি করে দেওয়া হয়েছে।
জাকির হোসেন নামে বাবু মিয়ার এক আত্মীয় বলেন, বাবুর ঘরের অভাব ছিল, প্রধানমন্ত্রী সেই ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। বাবুর এখন দরকার একটি চাকরি। যদি সেটির ব্যবস্থা করা হয়, তাহলে তার আর কোনো পিছুটান থাকবে না।
শুধু বাবু মিয়া নয়, সারা দেশে বাবু মিয়াদের মতো অসংখ্য গৃহহীনদের বিনামূল্যে ঘর বানিয়ে দিচ্ছে সরকার। এখন দেশজুড়ে চলছে তৃতীয় পর্যায়ের ঘর নির্মাণের কর্মযজ্ঞ। এ প্রসঙ্গে আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক যুগ্ম সচিব আবু ছালেহ মোহাম্মাদ ফেরদৌস খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘অন্তর্ভুক্তি উন্নয়নের যে মডেল আছে, শেখ হাসিনা মডেল সেখানে সব মানুষকে এগিয়ে নিয়ে আসার প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। তারই অংশ হিসেবে ভূমিহীন-গৃহহীন মানুষকে একক গৃহ দেওয়া হচ্ছে। এখানে বিধবা, প্রতিবন্ধী, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষকেও ঘর দেওয়া হচ্ছে। ’
১৯৯৭ সাল থেকে আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে চলতি অর্থবছর পর্যন্ত পুনর্বাসিত পরিবারের সংখ্যা ৭ লাখ ৮ হাজার ৩টি পরিবার। পরিবারের সদস্য পাঁচজন ধরে হিসাব করলে সে সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৫ লাখ ৪০ হাজার ১৫ জন। চলতি অর্থবছরে বরাদ্দ একক গৃহের সংখ্যা ১ লাখ ৮২ হাজার ৮০৩টি। আর বরাদ্দ অর্থের পরিমাণ ৩ হাজার ৯৭১ কোটি ৬ লাখ ৮৩ হাজার টাকা।