করোনাভাইরাস সংক্রমণের মধ্যেই এবার শুরু হলো পবিত্র মাহে রমজান। যে কারণে এ বছরের রমজান একেবারেই ব্যতিক্রম। করোনা রোধে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও এরই মধ্যে জীবনাচরণে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। রোজায়ও তা অব্যাহত থাকবে।
যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম এবং দীর্ঘদিন যাবৎ বিভিন্ন জটিল রোগ যেমন- ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, অ্যাজমা ইত্যাদিতে ভুগছেন; করোনা তাদের ক্ষেত্রে মাঝারি থেকে তীব্র সংক্রমণ করে থাকে। এ জন্য রোজায় খাদ্যাভ্যাসে বাড়তি সাবধানতা অবলম্বন করা জরুরি। রমজান মাসে সবাইকে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে শারীরিক সক্ষমতা বজায় রাখতে হবে।
এবার গ্রীষ্মকালে রোজা হওয়ায় প্রায় ১৪ ঘণ্টা পানাহার থেকে বিরত থাকতে হচ্ছে। তাই সাহরি ও ইফতারে সুষম খাবার নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ। তাই খাদ্যতালিকা নির্বাচনে কিছু বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। যেমন-
১. করোনা প্রতিরোধের জন্য ইফতার ও সাহরির খাদ্যতালিকায় অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট (ভিটামিন এ, সি, ই) ও জিঙ্কসমৃদ্ধ খাবার বেশি রাখতে হবে। এ ধরনের খাবার হিসেবে আমলকি, লেবু, জাম্বুরা, পেয়ারা, টমেটো, কমলা ইত্যাদি রাখা যায়। এছাড়া মৌসুমি ফল তরমুজ, পেঁপে, আনারস, জলপাই তালিকায় রাখা যেতে পারে। পাশাপাশি গাজর, মিষ্টি আলু, জিঙ্ক ও প্রোটিনসমৃদ্ধ মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, বাদাম, ডাল, গম জাতীয় খাবার, ওটস ইত্যাদি খেতে পারেন।
২. টকদই প্রোবায়োটিকের ভালো উৎস। যা শ্বাসযন্ত্র এবং পরিপাকতন্ত্রের সংক্রমণ রোধে কার্যকরী। তাই ইফতার বা সাহরিতে অল্প পরিমাণ টকদই খেতে পারেন।
৩. গ্রীষ্মকালীন রোজার কারণে ইফতার থেকে সাহরি পর্যন্ত সময়ে পানিশূন্যতা রোধে বেশি পরিমাণ পানি এবং তরল খাবার গ্রহণ করতে হবে। ইফতারে কচি ডাবের পানি, লেবুর শরবত, বেলের শরবত, ইসবগুলের ভুসি, কাঁচা আমের শরবত রাখলে পানিশূন্যতা রোধের পাশাপাশি ভিটামিন ও খনিজ লবণের ঘাটতি পূরণ হবে।
৪. সব ধরনের অতিরিক্ত তেলেভাজা খাবার পরিহার করুন। ইফতারে চিড়া, টকদই ও কলা খেতে পারেন। এ ছাড়া সেদ্ধ ছোলা, আদা, পুদিনাপাতা, লেবু, শসা, টমেটো দিয়ে মিশিয়ে খেতে পারেন। যা আঁশ, প্রোটিন, খনিজ লবণের চাহিদা পূরণ ও কোষ্ঠকাঠিন্য রোধে কার্যকর। পাশাপাশি ইফতারে মিশ্রফলের সালাদ খাওয়া যেতে পারে। ইফতারে চাল, ডাল মিশ্রিত পাতলা খিচুড়ি বা হালিম খেতে পারেন। যা মুখরোচক এবং সুষম খাবার। ২-৩টি খেজুর ইফতারে খাদ্যতালিকায় রাখতে পারেন।
৫. ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে রাতের খাবারকে ইফতারে এবং দুপুরের সমপরিমাণ খাবার সেহরির সময়ে খেতে হবে। সন্ধ্যায় হালকা খাবার যেমন- দুধ, ওটস ও বাদাম অথবা আটার রুটি, সবজি খাওয়া যাবে। হাইপোগ্লাইসেমিয়ার ঝুঁকি এড়ানোর জন্য সাহরি শেষ সময়ে গ্রহণ করবেন।
৬. ইউরিক অ্যাসিড এবং কিডনিজনিত সমস্যা থাকলে ডাল এবং বেসনের পরিবর্তে ইফতার তৈরিতে চালের গুঁড়া ও ময়দা ব্যবহার করতে পারেন। বিকল্প হিসেবে বেগুনি ও পিঁয়াজুর পরিবর্তে ডিম সিদ্ধ খেতে পারেন।
৭. যাদের ওজনাধিক্য আছে, তারা অতিরিক্ত তেল ও সরল শর্করা জাতীয় খাবার খাবেন না।
৮. সাহরিতে ভাত, সবজি, মাছ, মাংস, ডিম ও দুধ খাবেন।
৯. প্রক্রিয়াজাত খাবার, কোমল পানীয়, কৃত্রিম জুস, আইসক্রিম, চর্বিযুক্ত খাবার, অ্যালকোহল, জর্দা, সিগারেট ইত্যাদি পরিহার করতে হবে। কারণ এগুলো রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে ভাইরাস সংক্রমণে সাহায্য করতে পারে।
খাদ্যতালিকায় এসব কিছু নিয়ম মেনে চলার পাশাপাশি রোজার সময়ে করোনা প্রতিরোধে সামগ্রিক জীবনাচরণে আরও কিছু বিষয়ে সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত-
* করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করার কোনো বিকল্প নেই। এ জন্য বেশিরভাগ মুসলিম দেশেই মসজিদে তারাবিহর নামাজ না পড়তে উৎসাহিত করা হচ্ছে। অনেক জায়গায় বিধি-নিষেধও আরোপ করা হয়েছে। আমাদের দেশেও মুসল্লিদের প্রতি বাড়িতে তারাবিহ পড়তে অনুরোধ করা হয়েছে। বাড়িতে জামাতে নামাজ পড়ার ক্ষেত্রেও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে।
* কারো জ্বর-কাশি, ডায়রিয়া বা ফ্লুর উপসর্গ থাকলে এবং ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তি যেমন- বয়স্ক, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, ফুসফুসের রোগ আছে এমন ব্যক্তিরা মসজিদে যাবেন না। মসজিদে প্রবেশ, বের হওয়ার পথে এবং অজুর জায়গায় যেন ভিড় না হয়। সবাই শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখতে পারেন, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
* মুসলমানরা যে পদ্ধতিতে দিনে পাঁচবার অজু করেন, তা স্বাস্থ্যসম্মত বলেই আখ্যা দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। তবে মসজিদে ও বাড়িতে অজুর জায়গায় যথেষ্ট পানির প্রবাহ, সাবান, হ্যান্ডওয়াশ বা স্যানিটাইজারের ব্যবস্থা রাখতে হবে। এ ছাড়া টিস্যু এবং তা ফেলতে ঢাকনাযুক্ত বিন রাখতে হবে। প্রত্যেকেই ব্যক্তিগত জায়নামাজ ব্যবহার করবেন। হাঁচি-কাশির শিষ্টাচার মেনে চলবেন। মসজিদ কর্তৃপক্ষ দিনে কয়েকবার মসজিদের মেঝে, অজুর জায়গা, বাথরুম জীবাণুমুক্ত করবেন। দরজার হাতল, সিঁড়ির রেলিং, পানির কল, লাইট ও ফ্যানের সুইচ বারবার জীবাণুমুক্ত করতে হবে। এগুলো যথাসম্ভব স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। সব ক্ষেত্রেই নাক–মুখ–চোখ স্পর্শ করা থেকে এড়াতে হবে।
* সুস্থ থাকলে যে কেউ রোজা রাখতে পারবেন। তবে যথেষ্ট পুষ্টিকর, ভিটামিন ও খনিজযুক্ত খাবার খেতে হবে। প্রচুর পানি পান করতে হবে। বাইরের অস্বাস্থ্যকর খাবার খাবেন না। ধূমপান করবেন না। বাড়িতে সন্ধ্যার পর হালকা হাঁটাহাঁটি বা ব্যায়াম করবেন।
* জাকাত বা সদকার ব্যাপারে গণজমায়েত করা যাবে না। ইফতার বিতরণ বা ইফতার অনুষ্ঠানের ব্যাপারেও সাবধানতা অবলম্বন করুন। রোজায় সাধারণত বাইরে, মার্কেটে, কাঁচাবাজারে ভিড় হয়। এগুলোও এড়িয়ে চলুন।
সর্বোপরী সিয়াম সাধনার এই মাসে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করুন। যেন তিনি দ্রুত আমাদের এই করোনা বিপদ থেকে উদ্ধার করেন। সবাই সচেতন হোন, সংযম মেনে রোজার ভাব গাম্ভীর্য ও গুরুত্ব উপলব্ধি করুন।