শিক্ষার্থীদের ১০ হাজার টাকা দেয়ার গুজবে তোলপাড়

0 0
Read Time:9 Minute, 46 Second

সরকার মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ও অনার্সের ছাত্রছাত্রীদের ১০ হাজার টাকা করে অনুদান দেবে- এমন গুজবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রত্যয়নপত্রের ফরম কিনতে ভিড় করছেন শিক্ষার্থীরা।

প্রত্যয়নপত্র স্কুল থেকে দেয়ার নিয়ম থাকলেও এসব ফরম বিক্রি হচ্ছে শহরের ফটোকপির দোকানে দোকানে। কোনো কোনো দোকানি ২ টাকার ফরম বিক্রি করছেন ১০ টাকায়। আর তা কিনতে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি ভিড় করছেন অভিভাবকরাও। সেসব ফরম পূরণে করে স্কুলে স্কুলে জমাও দেয়া হচ্ছে।

রোববার কিশোরগঞ্জের একটি ফটোকপির দোকানে স্কুলের ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবকদের জটলার কারণে শহরের মূল সড়কে দেখা দেয় তীব্র যানজট। প্রায় এক ঘণ্টা ব্যাহত হয় যান চলাচল।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় গত ১৮ জানুয়ারি এক বিজ্ঞপ্তিতে শিক্ষার্থীদের অনুদান দেয়ার কথা জানায়। বিজ্ঞপ্তিতে অসুস্থ, দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত বা শিক্ষার কাজে ব্যয়ের জন্য ছাত্রছাত্রীদের এই অনুদান দেয়ার কথা জানানো হলেও কী পরিমাণ অর্থ দেয়া হবে তা উল্লেখ ছিল না।

এর পর গত ৪ মার্চ আরেক বিজ্ঞপ্তিতে এই অনুদান দেয়ার কথা বলে একটি চক্র শিক্ষার্থীদের জাতীয় পরিচয়পত্র, বিকাশ নম্বর ও গোপন পিন নিচ্ছে বলে সতর্ক করে।

এই ফর্ম কিনতে ভিড় করেন শিক্ষার্থী-অভিভাবকরা

এর মধ্যেই দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে খবর আসতে থাকে শিক্ষার্থীদের অনুদান পাইয়ে দেয়ার গুজব ছড়িয়ে বিভিন্ন স্কুলের প্রত্যয়নপত্রের ফরম বিক্রি হচ্ছে।

সবশেষ রোববার কিশোরগঞ্জের পাশাপাশি গাইবান্ধা থেকেও এমন খবর পাওয়া গেছে।

রোববার সকাল ১১টার দিকে কিশোরগঞ্জ শহরের আখড়াবাজার এলাকায় কিশোরগঞ্জ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের পাশে ওয়াই টু কে জোন নামের ফটোকপির দোকানের সামনে দেখা যায় শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের ভিড়।

স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্রী মাহিরা আক্তার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘গতকাল (শনিবার) আমার এক বান্ধবী ফোনে জানিয়েছে, সরকার নির্দিষ্ট কিছু শিক্ষার্থীকে অনুদান বাবদ ১০ হাজার টাকা করে দিবে। সে জন্য স্কুল থেকে একটি প্রত্যয়নপত্র নিতে হবে। পরে লটারির মাধ্যমে বাছাই করে অনুদান দেয়া হবে। স্কুলে সেই ফরম নাই। তাই ফরম নিতেই রতন মামার দোকানে এসেছি।’

তার সহপাঠী অহনা আক্তার বলেন, ‘প্রথমে শুনেছি সরকার শুধু অর্থনৈতিকভাবে অসচ্ছল শিক্ষার্থীদের অনুদান দিবে। এখন অনুদান গ্রহণ করতে সবাই নিজেকে গরিব দাবি করে ফরম পূরণ করে জমা দিচ্ছে। পরে লটারির মাধ্যমে কারা টাকা পাবে তা নির্ধারণ করা হবে। অনুদানের টাকা গ্রহণ করতেই এখান থেকে ফরম কিনে স্কুলে জমা দিয়েছি।’

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তি

দোকান থেকে ফরম নিতে আসা এক ছাত্রীর বাবা নূরুল হুদা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সারাদিন বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকি। সকালে বাচ্চার মা বলতেছে, আজকে কাজে যাওয়ার দরকার নাই। স্কুলে গিয়ে একটা ফরম পূরণ করে জমা দিয়ে আসো। শুনেছি সরকার ছাত্রীদেরকে ১০ হাজার টাকা করে দিবে। এই কথা শুনেই ফরম কিনতে এসেছি।’

তিনি জানান, দুই টাকার এই ফরম তিনি ১০ টাকায় কিনেছেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ফটোকপি দোকানের মালিক রতন মিয়া বলেন, ‘আমাকে কিছু না জিজ্ঞেস করে স্কুলের শিক্ষকদের জিজ্ঞেস করেন। তারা বলেছে ফরম বিক্রি করতে। তাই আমি বিক্রি করতেছি। আমি প্রতিটি ফরম পাঁচ টাকা করে বিক্রি করতেছি। এইটুকুই জানি।’

এই গুজব কীভাবে ছড়াল এবং প্রত্যয়নপত্রের ফরম শিক্ষার্থীরা কেন কিনছে তা জানতে কিশোরগঞ্জ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় যায় নিউজবাংলার প্রতিবেদক।

এ সময় সাংবাদিকের উপস্থিতি টের পেয়ে স্কুলের প্রধান ফটক থেকে দৌঁড়ে ভেতরে চলে যান স্কুলের এক কর্মচারী। ভেতরে গিয়ে দেখা গেল, সেখানেও ফরম কিনতে ছাত্রী ও অভিভাবকরা ভিড় করেছেন। সহকারী প্রধান শিক্ষক বিপদ ভঞ্চন বনিকের কক্ষে গিয়ে দেখা যায়, তিনি বেশ কিছু ফরমে সই করায় ব্যস্ত।

জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ছাত্রীরা আসছে প্রত্যয়নপত্র নিতে, তাই সই করে দিতেছি। আমি আর কিছু জানি না। ডিস্টার্ব না করে চলে যান, আমার কাজ করতে দিন।’

স্কুলের প্রধান শিক্ষক লুৎফুন্নাহারের সঙ্গে দেখা করতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মচারী বলেন, ‘ম্যাডাম স্কুলে নাই। উনার স্বামী অসুস্থ। তাই স্কুলে আসেন নাই।’

এ প্রসঙ্গে সহকারী জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা জুলফিকার হোসেন নিউজবাংলাকে জানান, অনুদান নিয়ে গুজবের ব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে সতর্ক করে বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়েছে। সেটি পাওয়ার পর সব স্কুলে জানানোও হয়েছে। তবে ফরম বিক্রির বিষয়টি তিনি জানেন না। এ ধরনের প্রত্যয়নপত্র স্কুল থেকেই দেয়ার কথা। এটি শিক্ষার্থীদের কেনার কথা না। বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখা হবে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় গত ১৮ জানুয়ারি এক বিজ্ঞপ্তিতে শিক্ষার্থীদের অনুদান দেয়া হবে বলে জানায়। এই অনুদান পেতে শিক্ষার্থীদের আবেদন করতে বলা হয়। বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়, অসুস্থ, দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হলে কিংবা শিক্ষার কাজে ব্যয়ের জন্য ছাত্র-ছাত্রীরা আবেদন করতে পারবেন। সেক্ষেত্রে দরিদ্র বা অনগ্রসর সম্প্রদায়ের শিক্ষার্থীদের অগ্রাধিকার দেয়া হবে। সেই আবেদনের জন্য নিজ নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে প্রত্যয়নপত্র নিয়ে জমা দিতে হবে। কিন্তু বিজ্ঞপ্তির কোথাও কী পরিমাণ অর্থ দেয়া হবে তা উল্লেখ ছিল না।

এর পর ৪ মার্চ আরেক বিজ্ঞপ্তিতে মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব ফজলুর রহমান সতর্ক করে জানান, এই অনুদান দেয়ার কথা বলে একটি চক্র শিক্ষার্থীদের জাতীয় পরিচয়পত্র, বিকাশ নম্বর ও গোপন পিন নিচ্ছে বলে অভিযোগ আসছে। এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে জেলায় জেলায় শিক্ষা কর্মকর্তাদের বলা হয়েছে।

বিজ্ঞপ্তি দিয়ে সতর্ক করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়

তবে নিউজবাংলার প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, শিক্ষার্থীদের অনুদান পাইয়ে দেয়ার কথা বলে বিভিন্ন স্কুলের প্রত্যয়নপত্র বিক্রি হচ্ছে।

শনিবার থেকে রোববার দুপুর পর্যন্ত গাইবান্ধা জেলা শহরের বিভিন্ন কম্পিউটার ও ফটোকপির দোকানে শিক্ষার্থীদের ফরম পূরণ করতে দেখা গেছে।

সাদুল্লাপুর শহরে দুই দিনই বিভিন্ন দোকানে ফরমের জন্য ভিড় করতে দেখা গেছে ছাত্রছাত্রীদের। তবে তাদের ফিরিয়ে দেন দোকানিরা।

জেলা শহরের মুক্তি আকতার নামে একাদশ শ্রেণির এক ছাত্রী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘করোনার কারণে সরকার নাকি ১০ হাজার টাকার দেবে। এ জন্য ফরম পূরণ করতে এসেছি। এখানে এসে শুনছি; এ সব নাকি গুজব। এখন বাড়ি ফিরে যাচ্ছি।’

Happy
Happy
0 %
Sad
Sad
0 %
Excited
Excited
0 %
Sleepy
Sleepy
0 %
Angry
Angry
0 %
Surprise
Surprise
0 %

Average Rating

5 Star
0%
4 Star
0%
3 Star
0%
2 Star
0%
1 Star
0%

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *