শেন ওয়ার্নের মৃত্যুতে শোক ছাপিয়েছে পুরো ক্রিকেট বিশ্ব

0 0
Read Time:8 Minute, 44 Second

একটা মৃত্যুশোকেই আচ্ছন্ন হয়ে ছিল ক্রিকেট বিশ্ব। রাওয়ালপিন্ডিতে অস্ট্রেলিয়া-পাকিস্তান টেস্ট ম্যাচের আগে যে খবর পেয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করেছে দুই দল, অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটাররা নেমেছেন কালো আর্মব্যান্ড পরে। কে জানত, সেই রাতেই এমন এক দুঃসংবাদ দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়বে যে রডনি মার্শের চলে যাওয়ার শোককে ছাপিয়ে গিয়ে সবাইকে তা অবিশ্বাসে বিমূঢ় করে দেবে!

সপ্তাহখানেক আগে হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত সাবেক অস্ট্রেলিয়ান উইকেটকিপার রডনি মার্শ এরপর থেকেই ছিলেন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। যা খারাপ কিছু শোনার মানসিক প্রস্তুতি নেওয়ার সময়টা অন্তত দিয়েছিল। কিন্তু শেন ওয়ার্ন আর নেই, বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো এই খবরে শোক তো অনেক পরের অনুভূতি, সবার আগে তো অবিশ্বাস! কোথাও ভুল হচ্ছে না তো!

যে মানুষটা ১২ ঘণ্টা আগে রডনি মার্শের মৃত্যুতে শোক জানিয়ে টুইট করেছেন, যাঁর শারীরিক কোনো সমস্যার কথা জানা যায়নি কখনো, তিনিই কিনা রডনি মার্শের পিছু পিছু যাত্রা করেছেন অনন্তলোকে। কোথাও ভুল হচ্ছে না তো!

কোনো না কোনো সূত্রে খবরটা পাওয়ার পর মনে মনে এই প্রার্থনা করতে করতেই ইন্টারনেটে ঝাঁপিয়ে পড়েছে মানুষ। খবরটা যেন ভুল হয়, খবরটা যেন ভুল হয়। তা তো হয়ইনি, বরং কিছুক্ষণের মধ্যেই সব সংশয় ঘুচিয়ে দিয়েছে কিংবদন্তির বিদায়শোকে ভেসে যাওয়া টুইটার-ফেসবুক-ইনস্টাগ্রাম। সবাইকে মেনে নিতে হয়েছে অবিশ্বাস্য সত্যিটা-এই মর্ত্যধামে আবির্ভূত সর্বকালের সেরা লেগ স্পিনার আর নেই।

খবরের সূত্র একটাই। অস্ট্রেলিয়ার ফক্স স্পোর্টস। যে সংস্থার সঙ্গে ধারাভাষ্যকার শেন ওয়ার্নের মোটা অঙ্কের চুক্তি। ওয়ার্নের ম্যানেজমেন্ট সংস্থার বরাত দিয়ে যারা জানিয়েছে, ‘শেনকে অচেতন অবস্থায় তাঁর ভিলায় পাওয়া গেছে। মেডিকেল স্টাফের সর্বোচ্চ চেষ্টার পরও তাঁকে বাঁচানো যায়নি।‌’ মৃত্যুর কারণ? রডনি মার্শকে যা তুলে নিয়ে গেছে, সম্ভবত সেই হার্ট অ্যাটাকই। মার্শেরটা নিশ্চিত, ওয়ার্নেরটা জোরালো অনুমান।

সেই অনুমান সত্যি বা মিথ্যা হোক, তাতে কিই-বা আসে যায়! শেন ওয়ার্ন আর নেই, এই নির্মম সত্যিটা তো আর তাতে বদলাচ্ছে না। ক্রিকেটের সবচেয়ে বিখ্যাত ওয়েবসাইট ক্রিকইনফোতে শেন ওয়ার্নের প্রোফাইলে লেখা হয়ে গেছে:

কোহ্‌ সামুই! কোহ্ সামুই কেন? কারণ হতে পারে একটাই। থাইল্যান্ডের ছোট্ট এই দ্বীপে তো মানুষ ছুটি কাটাতেই আসে। খেলা ছাড়ার পর আরও ঊর্ধ্বশ্বাস ব্যস্ততার ধারাভাষ্য-জীবন থেকে একটু হাঁপ ছাড়তেই হয়তো কোহ্ সামুইয়ে এসেছিলেন শেন ওয়ার্ন। কে জানত, তাঁর শেষনিশ্বাসটা এখানেই পড়বে বলে ঠিক করে রেখেছিলেন বিধাতা!

রডনি মার্শের মতো পরিণত বয়সে হলেও শেন ওয়ার্নের মৃত্যু তুমুল আলোড়ন তুলত ক্রিকেট বিশ্বে। এমন অকালে চলে যাওয়াটা যা বাড়িয়ে দিচ্ছে আরও সহস্র গুণ। শেন ওয়ার্ন তো শুধুই একজন ক্রিকেটার ছিলেন না, তিনি ছিলেন যুগবদলের নায়ক। ক্রিকেট সব ক্রিকেটারই খেলেন, কিন্তু হাতে গোনা কয়েকজনই পারেন খেলাটাকে বদলে দিতে। শেন ওয়ার্ন সেই ক্ষণজন্মা ক্রিকেটারদের একজন, যাঁদের আবির্ভাবের আগে-পরে খেলাটা আর এক থাকেনি। ১৪৫ টেস্টে ৭০৮ আর ১৯৪ ওয়ানডেতে ১৯৪ উইকেটের সাধ্য কি তা পুরোটা বোঝানোর!

খেলা ছাড়ার অনেক আগেই সর্বকালের সেরা লেগ স্পিনারের স্বীকৃতি পেয়ে গেছেন। শুধু লেগ স্পিনের সীমানায় বেঁধে না রেখে ‘সর্বকালের সেরা স্পিনার’ও বলেন অনেকেই। মুত্তিয়া মুরালিধরনের দুই সংস্করণেই অনেক বেশি উইকেট, কিন্তু সেই রেকর্ডে পাদটীকা হিসেবে তাঁর বোলিং অ্যাকশন নিয়ে সংশয়টাও থাকে। লেগ স্পিন-অফ স্পিনের সীমানাতেই আটকে না থেকে পেস-স্পিন মিলিয়ে শেন ওয়ার্নকে সর্বকালের সেরা বোলারই-বা বলা হবে না কেন, এমন আলোচনাও তো হয়।

তাতেও আসলে শেন ওয়ার্নকে পুরো বোঝানো যায় না। ওয়ার্ন মানে তো শুধুই উইকেট আর রান নয়। হ্যাঁ, রানও। সেঞ্চুরি ছাড়া টেস্ট ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি রান করার রেকর্ডও তাঁর। আশির দশকে পাকিস্তানের আবদুল কাদির বিলুপ্তপ্রায় লেগ স্পিনকে পুনর্জীবন দিয়েছিলেন। কিন্তু লেগ স্পিনকে অন্য মাত্রা দিয়ে সেটিকে ‘গ্ল্যামারাস’ করে তোলার কৃতিত্ব তো শুধু ব্লন্ডচুলো বোলারকেই দিতে হয়। এখানেই তো ওয়ার্ন-মহিমার শেষ নয়। খেলার মূল কথা যদি হয় বিনোদন, সেটিও ওয়ার্নের চেয়ে বেশি আর কজন দিতে পেরেছে! ওয়ার্নের বোলিং ক্রিকেটকে এমন রূপে-রঙে-রসে সাজিয়ে উপহার দিয়েছে যে ‘ব্যাটসম্যানদের খেলা’য়ও লেগ স্পিন বোলিং দেখতেই মাঠে ছুটে গেছেন দর্শক। ওয়ার্ন বল হাতে নেওয়ামাত্র শুধু ব্যাটসম্যানদের হৃৎকম্পনই বেড়ে যায়নি, গ্যালারির মতো টিভি সেটের সামনে বসা দর্শকও নড়েচড়ে বসত।

শুধু তো আর খেলা নয়, তারকা হতে খেলোয়াড়ি সাফল্যের বাইরেও কিছু লাগে। ওয়ার্নের তো তা ছিলই। অনেকে বলতে পারেন, একটু বেশিই ছিল। বোলিংয়ের মতোই বর্ণময় তাঁর জীবন, সে জীবনই কখনো কখনো মনে করিয়ে দিয়েছে, বল হাতে যতই অতিমানবীয় মনে হোক, ওয়ার্নও বাকি সবার মতো রক্ত-মাংসেরই মানুষ। মাঠের বাইরে তাঁর কাণ্ডকীর্তি নিয়মিত ট্যাবলয়েডের পাতা ভরিয়েছে। ডোপ টেস্টে ধরা পড়ে নিষিদ্ধ হয়েছেন। তাতে তাঁর আকর্ষণটা বেড়েছে বৈ কমেনি! সব মিলিয়ে শেন ওয়ার্ন ছিলেন তাঁর সময়ের ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় সুপারস্টার। এমন নন্দিত, এমন বিতর্কিত, এমন আলোচিত ক্যারিয়ার ক্রিকেট ইতিহাসেই কি আর কারও ছিল!

২০০৭ সালে শেন ওয়ার্নের অবসর নিয়ে লেখাটায় একটা কবিতার পঙ্‌ক্তি ছিল, ‘পাখি উড়ে চলে গেলে তার পালক পড়ে থাকে।’ এরপর শেষ লাইনটা ছিল এমন-শেন ওয়ার্ন চলে যাওয়ার পরও অনেক ‘পালক’ই পড়ে থাকবে।

কে জানত, বছর পনেরো পর শেন ওয়ার্নকে নিয়ে আবার লিখতে গিয়ে মনে হবে, শেষ লাইনটা অপরিবর্তিত রেখে দিলেই তো হয়!

Happy
Happy
0 %
Sad
Sad
0 %
Excited
Excited
0 %
Sleepy
Sleepy
0 %
Angry
Angry
0 %
Surprise
Surprise
0 %

Average Rating

5 Star
0%
4 Star
0%
3 Star
0%
2 Star
0%
1 Star
0%

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *