স্বাধীনতার ৫১ বছর, মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি

0 0
Read Time:10 Minute, 10 Second

বরিশাল জেলার মুলাদী উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধার ভাতাপ্রাপ্ত সংখ্যা ছিল ৬৬১ জন। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের মুক্তিযোদ্ধা তথ্য ব্যবস্থাপনা সিস্টেমে (এমআইএস) ৬০৮ জন মুক্তিযুদ্ধার নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এই উপজেলায় জাতীয় পরিচয়পত্র ও অন্যান্য সমস্যার কারণে ৫৩ জনের নাম এই তালিকায় উঠেনি। তাদের ভাতা বন্ধ রয়েছে। এছাড়া এই উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধা যাচাই-বাছাইয়ের জন্য ‘ক’ তালিকা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে ৭০ জনের নাম। এভাবে খ ও গ তালিকাও মুক্তিযুদ্ধাদের নাম রয়েছে। কিন্তু ১৩ বছরেও এই উপজেলার যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া এখনো শেষ হয়নি বলে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা জানান।

এ বিষয়ে মুলাদী উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা এমদাদ খান সংবাদকে বলেন, ‘মুলাদী উপজেলায় সাড়ে ৬০০ জন মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে প্রায় ৩২০ জন জীবিত আছেন। বিভিন্ন সময় মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা পরিবর্তন হয়েছে। কিছুদিন আগেও ভাতাপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল ৬৬১ জন। এখন তা কমে হয়েছে ৬০৮ জন। ব্যাংকের সার্ভারের সমস্যা কারণে প্রতিমাসেই মুক্তিযোদ্ধারের ভাতাপ্রাপ্তিতে সমস্যা হচ্ছে। এছাড়া বিভিন্ন তালিকা অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধারের যাচাই-বাছাইয়ের কাজ চলছে।’ তাই যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া শেষ করা ছাড়া মুক্তিযোদ্ধাদের প্রকৃত সংখ্যা বলা কঠিন বলে জানান তিনি।

এভাবে সারাদেশের বিভিন্ন উপজেলায় এখনো মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক সংখ্যা নির্ধারণ হয়নি। তাই বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা কত? এ প্রশ্নের উত্তর কেউ দিতে পারছে না। সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে নতুন করে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকাও তৈরি হয়েছে। স্বাধীনতার ৫১ বছর পরও মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি বিরাজ করছে দেশের সব শ্রেণী-পেশার মানুষের মধ্যে।

তবে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দুই লাখের বেশি হবে না। তিনি বৃহস্পতিবার (২৪ মার্চ) সংবাদকে বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা ওয়েবসাইডে প্রকাশ করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত যারা ভাতা পাচ্ছেন তাদের সংখ্যা এক লাখ ৮৭ হাজার। তবে কিছু নাম পেন্ডিং রয়েছে। এগুলো আদালতে মামলা থাকার কারণে।’ এর সংখ্যা ২-৩ হাজারের বেশি হবে না বলে জানান তিনি।

মুক্তিযোদ্ধাদের যাচাই-বাছাই

হয়েছে ১১ বার

স্বাধনীতার ৫১ বছরে ছয়বার মুক্তিযোদ্ধা তালিকা সংযোজন-বিয়োজন হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধার বয়স, সংজ্ঞা ও মানদন্ড পাল্টেছে ১১ বার। সেনাবাহিনীর সংরক্ষিত দলিলের তথ্য অনুযায়ী, স্বাধীনতার পর কয়েকজন সেক্টর কমান্ডার ও সাব-সেক্টর কমান্ডারদের প্রকাশিত বইয়ে নিয়মিত বাহিনীর ২৪ হাজার ৮০০ এবং অনিয়মিত বাহিনীর এক লাখ ৭ হাজারসহ মোট এক লাখ ৩১ হাজার ৮০০ জনকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গণ্য করা হয়। ১৯৯৮ সালের আগ পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের চার-পাঁচটি তালিকা প্রণয়নের উদ্যোগ নিলেও তা চূড়ান্ত মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আমিন আহমেদ চৌধুরী বিভিন্ন সেক্টরের তথ্য নিয়ে একটি তালিকা ভলিউম আকারে প্রকাশ করেন, যাতে ৭০ হাজার ৮৯৬ জন মুক্তিযোদ্ধাকে তালিকাভুক্ত করা হয়। বাকি ৬০ হাজার ৯০৪ জন কোন তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হবেন তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়।

১৯৯৮ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে তার কার্যালয়ের তৎকালীন মহাপরিচালক মমিনউল্লাহ পাটোয়ারীর মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ প্রথমবারের মতো একটি তালিকা করে। ওই তালিকাটি মুক্তিযোদ্ধা সংসদে ‘লাল বই’ নামে সংরক্ষিত রয়েছে। বর্তমানে এই তালিকায় এক লাখ ৫৪ হাজার জনের নাম থাকলেও সবার নামে গেজেট প্রকাশিত হয়নি। এই ‘লাল বই’য়ে আমিন আহমেদের তালিকার বেশিরভাগের নাম অন্তর্ভুক্ত হলেও কিছু নাম বাদ পড়েছে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিগত চারদলীয় জোট সরকার মুক্তিযোদ্ধা সংসদকে দায়িত্ব না দিয়ে তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদ সচিব সা’দত হুসাইনের নেতৃত্বে চারজন সচিব ও খেতাবধারী মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে একটি জাতীয় কমিটি করে। ওই কমিটির দায়িত্ব ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক তালিকা তৈরি করে সরকারকে সুপারিশ করা, যাদের নাম গেজেট আকারে প্রকাশ করা হবে। ওই জাতীয় কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে ২০০২ সালের ৪ মার্চ সশস্ত্র বাহিনীর ৩৯ হাজার মুক্তিযোদ্ধার নামে ‘বিশেষ গেজেট’ এবং এক লাখ ৫৯ হাজার মুক্তিযোদ্ধার নামে ‘গেজেট’ প্রকাশ করা হয়। বিএনপি সরকার নতুন করে আরও ৪৪ হাজার জনকে মুক্তিযোদ্ধার সনদ দিয়ে মোট এক লাখ ৯৮ হাজার জনের নামে গেজেট প্রকাশ করে।

চারদলীয় জোট আমলে ৭২ হাজার ‘ভুয়া’ ব্যক্তিকে মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় সন্নিবেশিত করা হয় বলে জাতীয় সংসদে অভিযোগ তোলেন তৎকালীন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী এ বি তাজুল ইসলাম। এরপর ২০০৯ সালের ১৩ মে তালিকা যাচাই-বাছাইয়ের সিদ্ধান্ত নেয় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। তাজুল ইসলামও ডেপুটি কমিশনার ও ইউএনওদের নিয়ে কমিটি করে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা যাচাই-বাছাইয়ের দায়িত্ব দেন।

মুক্তিযোদ্ধা সংসদকে তালিকা তৈরি করে ডিসি-ইউএনওদের কাছে দেয়ার দায়িত্ব দেয়া হয়। ডিসি-ইউএনওদের নেতৃত্বের কমিটি দুই বছরেও তালিকা যাচাইয়ের কাজ শেষ করতে না পারায় মন্ত্রণালয় এবং এ সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির হস্তক্ষেপে প্রশ্নবিদ্ধ ৬২ হাজার জনের তালিকা এবং নতুন করে আরও এক লাখ ৪৫ হাজার জনের নাম অন্তর্ভুক্তির তালিকা যাচাই-বাছাইয়ের দায়িত্ব দেয়া হয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদকে। কিন্তু ওই সময়কার মুক্তিযোদ্ধা সংসদের মেয়াদ শেষ পর্যায়ে থাকায় এ যাচাই-বাছাইয়ের কাজ আর এগোয়নি বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

আওয়ামী লীগ সরকার ২০১০-২০১২ সালে আরও ১১ হাজার জনকে মুক্তিযোদ্ধার সনদ দিয়ে মোট দুই লাখ ৯ হাজার জনের নাম তালিকাভুক্ত করে। পাশাপাশি কয়েকজন সচিবের সঙ্গে কয়েকশ’ সরকারি কর্মকর্তা এবং মুক্তিযোদ্ধা সনদধারীর গেজেট বাতিল করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়।

বিএনপি সরকারের সময় নতুন করে তালিকাভুক্ত ৪৪ হাজারের বেশিরভাগ এবং বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় তালিকাভুক্ত ১১ হাজারের অর্ধেকই ‘ভুয়া’ বলে শনাক্ত করা হয়। আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে বেশ কয়েক বছরজুড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা যাচাই-বাছাইয়ের কাজটি চললেও পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রণয়নের কাজ নানা কারণে আর শেষ করা যায়নি বলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান।

Happy
Happy
0 %
Sad
Sad
0 %
Excited
Excited
0 %
Sleepy
Sleepy
0 %
Angry
Angry
0 %
Surprise
Surprise
0 %

Average Rating

5 Star
0%
4 Star
0%
3 Star
0%
2 Star
0%
1 Star
0%

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *